হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার আগে যা জানা জরুরি
হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার আগে যা জানা জরুরি
| হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার আগে যা জানা জরুরি |
বর্তমান সময়ে চিকিৎসা ব্যয় দ্রুত বেড়ে চলেছে। এক সময় যে চিকিৎসা কয়েক হাজার টাকায় সম্ভব ছিল, আজ সেটি লাখ টাকায় পৌঁছেছে। হঠাৎ অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, অপারেশন বা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা—এসব যেকোনো পরিবারকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।
এই বাস্তবতায় হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয় আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু সমস্যা হলো—অনেকেই হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেন না বুঝে, ফলে ক্লেইমের সময় নানা সমস্যায় পড়েন। তাই হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভালোভাবে জানা জরুরি।
১. হেলথ ইন্স্যুরেন্স কী
হেলথ ইন্স্যুরেন্স হলো একটি আর্থিক চুক্তি, যেখানে আপনি নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন এবং এর বিনিময়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আপনার চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচ বহন করে।
হেলথ ইন্স্যুরেন্স সাধারণত কভার করে—
-
হাসপাতালে ভর্তি (Hospitalization)
-
অপারেশন ও সার্জারি
-
ডাক্তার ফি
-
ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী
-
ডায়াগনস্টিক টেস্ট
-
ICU ও কেবিন চার্জ
২. হেলথ ইন্স্যুরেন্স কেন জরুরি
২.১ চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমায়
একটি বড় অসুস্থতা মুহূর্তেই সঞ্চয় শেষ করে দিতে পারে। হেলথ ইন্স্যুরেন্স এই চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
২.২ মানসিক শান্তি দেয়
চিকিৎসার সময় “টাকা আসবে কোথা থেকে?”—এই দুশ্চিন্তা না থাকলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।
২.৩ পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা
হেলথ ইন্স্যুরেন্স থাকলে পরিবারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভেঙে পড়ে না।
৩. হেলথ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান ধরন
৩.১ ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স
-
একজন ব্যক্তির জন্য
-
আলাদা কভারেজ
-
যাদের পরিবার ছোট বা আলাদা প্রয়োজন আছে
৩.২ ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্স
-
পুরো পরিবার একটি পলিসির আওতায়
-
বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান কভার
-
তুলনামূলক কম প্রিমিয়াম
👉 মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয়
৩.৩ গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স
-
অফিস বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে
-
প্রিমিয়াম কম
-
চাকরি ছাড়লে কভার শেষ হতে পারে
৪. হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার আগে যেসব বিষয় অবশ্যই জানা জরুরি
৪.১ Sum Insured (কভারেজ সীমা)
এটি হলো সর্বোচ্চ কত টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা খরচ ইন্স্যুরেন্স কভার করবে।
✔ শহর ও হাসপাতালের খরচ অনুযায়ী নির্বাচন করুন
✔ খুব কম কভার নিলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে
উদাহরণ:
বড় শহরে থাকলে কমপক্ষে ৫–১০ লাখ টাকার কভার ভালো।
৪.২ প্রিমিয়াম
-
প্রিমিয়াম আপনার বয়স, স্বাস্থ্য, কভারেজ ও পলিসির ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়
-
কম প্রিমিয়াম মানেই সব সুবিধা নয়
👉 ব্যালান্স বজায় রাখুন—প্রিমিয়াম + কভারেজ
৪.৩ Waiting Period (অপেক্ষাকাল)
অনেক রোগ সঙ্গে সঙ্গে কভার হয় না।
সাধারণত—
-
Pre-existing disease: ২–৪ বছর
-
Maternity benefit: ২–৩ বছর
-
কিছু নির্দিষ্ট রোগ: নির্দিষ্ট সময় পরে কভার
👉 পলিসি নেওয়ার সময় এটি ভালোভাবে জেনে নিন।
৪.৪ Pre-existing Disease কী
যে রোগ বা শারীরিক সমস্যা পলিসি নেওয়ার আগে থেকেই ছিল, তাকে Pre-existing disease বলে।
⚠️ এগুলো প্রথম বছরেই কভার হয় না
⚠️ তথ্য গোপন করলে ক্লেইম বাতিল হতে পারে
👉 সব রোগ সৎভাবে ঘোষণা করুন।
৪.৫ Cashless বনাম Reimbursement ক্লেইম
Cashless:
-
নেটওয়ার্ক হাসপাতালে ভর্তি হলে
-
কোম্পানি সরাসরি বিল মেটায়
Reimbursement:
-
আগে নিজে খরচ করবেন
-
পরে কাগজ জমা দিয়ে টাকা ফেরত পাবেন
👉 Cashless সুবিধা থাকলে সবচেয়ে ভালো।
৪.৬ Network Hospital
-
কোন কোন হাসপাতালে cashless সুবিধা আছে তা দেখুন
-
আপনার নিকটবর্তী ভালো হাসপাতাল তালিকায় আছে কিনা যাচাই করুন
৪.৭ Exclusions (যা কভার হয় না)
সব হেলথ ইন্স্যুরেন্সে কিছু জিনিস কভার হয় না, যেমন—
-
কসমেটিক সার্জারি
-
ইচ্ছাকৃত আঘাত
-
নেশাজনিত অসুস্থতা
-
নির্দিষ্ট পরীক্ষামূলক চিকিৎসা
👉 এই তালিকা না পড়লে পরে সমস্যা হয়।
৪.৮ Co-payment ও Deductible
-
Co-payment: খরচের একটি অংশ আপনাকে দিতে হবে
-
Deductible: নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ নিজে বহন করতে হবে
👉 এগুলো থাকলে প্রিমিয়াম কম হয়, কিন্তু ক্লেইমে খরচ বাড়ে।
৪.৯ রিনিউয়াল ও লাইফটাইম কভার
-
পলিসি আজীবন রিনিউ করার সুবিধা আছে কিনা দেখুন
-
বয়স বাড়লেও কভার চালু থাকবে কিনা যাচাই করুন
৫. হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার ধাপে ধাপে নিয়ম
-
নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য প্রোফাইল বিশ্লেষণ করুন
-
কভারেজ প্রয়োজন ঠিক করুন
-
বিভিন্ন কোম্পানির পলিসি তুলনা করুন
-
Network hospital ও cashless সুবিধা দেখুন
-
শর্তাবলি ভালোভাবে পড়ুন
-
সঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন করুন
-
পলিসি ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করুন
৬. হেলথ ইন্স্যুরেন্সে সাধারণ ভুল
❌ শুধুই কম প্রিমিয়াম দেখে পলিসি নেওয়া
❌ রোগের তথ্য গোপন করা
❌ Waiting period না বোঝা
❌ Network hospital না দেখা
❌ সময়মতো রিনিউ না করা
৭. বাস্তব উদাহরণ
রফিকের অভিজ্ঞতা:
রফিক একটি ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্স নিলেন।
হঠাৎ তার বাবার হার্ট সার্জারি লাগল—খরচ প্রায় ৩ লাখ টাকা।
ইন্স্যুরেন্স থাকায় পরিবারকে ঋণ নিতে হয়নি।
👉 সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত পরিবারকে বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেওয়া মানে শুধু চিকিৎসার খরচ মেটানো নয়—এটি হলো পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা, মানসিক শান্তি এবং ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। সঠিক পলিসি নির্বাচন করতে হলে প্রিমিয়াম নয়, বরং কভারেজ, শর্তাবলি ও সুবিধার দিকে বেশি নজর দেওয়া জরুরি।
আজ বুঝে নেওয়া একটি হেলথ ইন্স্যুরেন্স
আগামী দিনে আপনার পরিবারের সবচেয়ে বড় ভরসা হতে পারে।