| ইন্স্যুরেন্স |
টার্ম ইন্স্যুরেন্স: সংজ্ঞা, কার্যপ্রণালী, সুবিধা ও অসুবিধা
জীবন কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। প্রতিটি মানুষ জীবনের যাত্রায় বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হয়। হঠাৎ দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, বা অপ্রত্যাশিত মৃত্যু—এই সব ঘটনা আমাদের পরিকল্পনার বাইরে ঘটে। এই অনিশ্চয়তার মুখে পরিবার আর্থিকভাবে বিপন্ন হতে পারে।
এখানেই টার্ম ইন্স্যুরেন্স বা “Term Life Insurance” গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি কেবল একটি আর্থিক চুক্তি নয়; এটি পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, মানসিক শান্তি এবং ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনার একটি হাতিয়ার।
ছোট গল্পের মাধ্যমে বোঝা যাক:
গল্প:
রাকিব একজন ৩৫ বছর বয়সী পিতা। তিনি প্রতিদিন অফিসে যান, সন্তানদের পড়াশোনা ও পরিবারের জীবনযাত্রা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। হঠাৎ একদিন দুর্ঘটনা ঘটে। রাকিবের লাইফ ইন্স্যুরেন্স থাকায় তার স্ত্রী ও দুই সন্তান আর্থিকভাবে নিরাপদ থাকে।
এ গল্পটি আমাদের শেখায় যে, জীবন অনিশ্চয়তার সাথে ভরা এবং টার্ম ইন্স্যুরেন্স সেই অনিশ্চয়তাকে সামলানোর জন্য একটি “নিরাপত্তার জাল” তৈরি করে।
টার্ম ইন্স্যুরেন্স কী
টার্ম ইন্স্যুরেন্স হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জীবনবীমা, যা পলিসিধারীর মৃত্যু বা অকালমৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
মূল বৈশিষ্ট্য:
শুধুমাত্র জীবন কভার প্রদান করে, কোনো সঞ্চয় বা বিনিয়োগের সুবিধা নেই।
নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বৈধ থাকে (যেমন ১০, ২০ বা ৩০ বছর)।
সময় শেষ হলে পলিসি শেষ হয়ে যায়, অর্থ ফেরত পাওয়া যায় না।
উদাহরণ:
রফিক ২০ বছরের টার্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স নেন। এই সময়ের মধ্যে যদি দুর্ঘটনায় মারা যান, তার পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। যদি রফিক জীবিত থাকেন, ২০ বছরের শেষে কোনো অর্থ ফেরত আসে না।
মানবিক ব্যাখ্যা:
টার্ম ইন্স্যুরেন্স হলো একটি “সুরক্ষা জাল,” যা পরিবারকে অনিশ্চিত সময়ে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে।
টার্ম ইন্স্যুরেন্সের কার্যপ্রণালী
ধাপ ১: প্রয়োজন নির্ধারণ
পরিবারের আয়, জীবনযাত্রার খরচ, ঋণ ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বিবেচনা করে কতটা কভার দরকার তা ঠিক করা।
ধাপ ২: পলিসি নির্বাচন
টার্ম লাইফ, প্রিমিয়ামের পরিমাণ ও কভারেজ নির্ধারণ করা।
উদাহরণ: ৩০ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি ৫০ লাখ টাকার কভার নিতে পারেন, প্রিমিয়াম মাসিক নির্ধারণ করে।
ধাপ ৩: আবেদন প্রক্রিয়া
আবেদন ফর্ম পূরণ
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রদান
প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে পলিসি কার্যকর করা
ধাপ ৪: প্রিমিয়াম প্রদান
নিয়মিত প্রিমিয়াম দেওয়ার মাধ্যমে কভারেজ বজায় থাকে।
ধাপ ৫: দাবি বা ক্লেইম
দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবার কাগজপত্র জমা দেয়।
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যাচাই করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
উদাহরণ:
সেলিম টার্ম ইন্স্যুরেন্স নেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে, পরিবার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে অর্থ পান।
টার্ম ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা
সস্তা প্রিমিয়াম
অন্যান্য লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তুলনায় প্রিমিয়াম অনেক কম।
উদাহরণ: ৩০ বছর বয়সী একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি মাসে ৫০০০ টাকা দিয়ে ৫০ লাখ টাকা কভার নিতে পারেন।
সরল কাঠামো
পলিসির শর্ত সরল ও সহজ।
কোনো জটিল বিনিয়োগ বা সঞ্চয় উপাদান নেই।
পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা
মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবার বড় আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।
উদাহরণ: দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া একজন পিতার পরিবার ইন্স্যুরেন্সের অর্থ ব্যবহার করে জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
বড় ঋণ, সন্তানদের শিক্ষার খরচ বা বড় ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের কভার প্রদান।
টার্ম ইন্স্যুরেন্সের অসুবিধা
কোনো সঞ্চয় নেই
টার্ম ইন্স্যুরেন্স শুধুমাত্র মৃত্যু বা দুর্ঘটনার জন্য কভার দেয়।
সময় শেষ হলে কোনো অর্থ ফেরত আসে না।
সময় সীমিত
পলিসি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বৈধ।
সময় শেষ হলে নতুন পলিসি নিলে প্রিমিয়াম বেশি হতে পারে।
স্বাস্থ্য বা বয়সের কারণে প্রিমিয়াম বৃদ্ধি
যদি সময়কালে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় বা বয়স বাড়ে, নতুন পলিসির প্রিমিয়াম বেশি হতে পারে।
বিনিয়োগ সুবিধা নেই
অন্যান্য লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মতো সঞ্চয় বা বিনিয়োগের সুযোগ নেই।
বাস্তব উদাহরণ ও গল্প
উদাহরণ ১: পরিবারিক নিরাপত্তা
আলম ৩০ বছর বয়সে ২০ বছরের টার্ম ইন্স্যুরেন্স নেন। লক্ষ্য: সন্তানদের পড়াশোনার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
যদি আলম ২০ বছরের মধ্যে মারা যান, পরিবার ইন্স্যুরেন্সের অর্থ ব্যবহার করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে।
যদি বেঁচে থাকেন, কোনো অর্থ ফেরত নেই।
উদাহরণ ২: ঋণ সুবিধা
ফারহান বাড়ি বানানোর জন্য ব্যাংক ঋণ নেন। তার টার্ম ইন্স্যুরেন্স থাকায় ব্যাংক সহজে ঋণ মঞ্জুর করে।
মানবিক ব্যাখ্যা:
টার্ম ইন্স্যুরেন্স হলো পরিবারকে “অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার নেট,” যা জীবনযাত্রাকে ধারাবাহিক রাখে।
টার্ম ইন্স্যুরেন্সের সাফল্য এবং পরিকল্পনা
সঠিক পরিকল্পনা:
প্রয়োজন অনুযায়ী কভার নির্ধারণ।
পলিসি বাছাই করে প্রিমিয়াম ও কভার বিবেচনা।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদান নিশ্চিত করা।
সফল উদাহরণ:
রাকিব ৩০ বছর বয়সে ৫০ লাখ টাকার টার্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স নেন। ১৫ বছর পর দুর্ঘটনা ঘটে। তার পরিবার ইন্স্যুরেন্সের অর্থ ব্যবহার করে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যায় এবং ঋণ পরিশোধ করে।
টার্ম ইন্স্যুরেন্স হলো সবচেয়ে সরল, সস্তা এবং কার্যকর লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ধরন। এটি পরিবারকে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সহজ করে এবং মানসিক শান্তি দেয়।
মানবিকভাবে:
টার্ম ইন্স্যুরেন্স হলো একটি নিরাপত্তার জাল—আপনার না থাকলেও আপনার পরিবার জীবনের প্রয়োজনীয় খরচ চালিয়ে যেতে পারবে।
মূল পয়েন্টসমূহ:
পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা
ঋণ সুবিধা
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
সরল কাঠামো ও সস্তা প্রিমিয়াম
কোনো সঞ্চয় বা বিনিয়োগ নেই
0 মন্তব্যসমূহ